শরীরের সাথে সাথে, মনটাকেও করোনার থাবা থেকে বাঁচিয়ে রেখো বন্ধু...............
অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি (LSU) তে পড়তে যাওয়া হয়েছিল আমার l বর্তমান টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করে, প্রথম দুই বছরে দুইটা চাকুরী পাল্টালাম l প্রথম চাকুরীটা ছিল একেবারে নতুন ভাবে স্থাপিত রপ্তানিমুখী ডেনিম ফেব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টে l নতুন ফ্যাক্টরি বলে জনবল খুব বেশি ছিল না, দিনের মধ্যে ১৮ ঘন্টাও ডিউটি করতে হয়েছে l অনেকদিন সূর্য কখন উঠেছে আর কখন ডুবেছে বুঝতেও পারিনি l জীবনের প্রথম চাকরি বলে, অন্যরকম একটা উদ্দীপনা কাজ করতো l বছর ঘুরতেই সব উদ্দীপনা কেমন যেন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে লাগল ! চাকুরীটা আর তেমন ভালো লাগাতে পারছিলাম না নিজেকে l ছোটবেলা থেকেই অনেক টিউশনি করতাম বলে কিনা, শিক্ষকতা পেশার প্রতি বেশ একটা টান অনুভব করছিলাম l কিছুদিন চেষ্টা করে, একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা জীবন শুরু করলাম l
শিক্ষকতা
পেশায় কিছুটা থিতু হয়ে বুঝলাম, আমাকে মাস্টার্স, পিএইচডি করতে হবে l কিছুদিনের মধ্যেই জাপান সরকারের 'Youth Development Program' এ মাস্টার্স এর জন্য স্কলার্শিপ আবেদন করলাম, কোন
ইতিবাচক সারা পেলাম না l কমনওয়েলথ স্কলারশিপের আবেদন
করলাম পরপর দু'বছর, কাজ হলোনা l
কারণ খুঁজতে গিয়ে জানলাম, টেক্সটাইল এর
জন্য, এই স্কলারশিপ গুলোর বরাদ্দ খুবই সীমিত l বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ, দেশের আরো অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-ছাত্রীরাই
অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে বলে জানলাম l উপরন্তু এসকল স্কলারশিপের
জন্য নাকি খুঁটির জোর লাগে!! এছাড়াও আমাদের সেই সময়ের টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়
যেভাবে ফলাফল ঘোষণা করতো, সেটি আসলে নতুন গ্রেডিং পলিসিতে
সিজিপিএ সিস্টেমে না, পুরাতন নিয়মে ক্লাস সিস্টেমে,
যেখানে শতকরা ৬০ পারসেন্ট নম্বর পেলে ফার্স্ট ক্লাস ধরা হতো l
তখন শিক্ষকদের মানসিকতা ছিল কোন ছাত্র বেশ ভালো করলে তাকে ১০ এ ৬
দেয়া হবে, কারণ ৬০ ভাগ মার্ক পেলেই তো সর্বোচ্চ ফার্স্ট
ক্লাস পাওয়া হয়ে যায় !! যাই হোক আমার টেক্সটাইল ডিগ্রিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েও
যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিজিপিএ ধারীদের তুলনায় বাজারে আমাকে নিচু মানের
ছাত্র হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে, সেটি টের পেলাম l
খুজতে
থাকলাম, কোথায়
গেলে আমার মাস্টার্স, পিএইচডি পড়ার সুযোগ হবে l জানতে পারলাম, জার্মান ভাষা শিখলে নাকি
জার্মান সরকার বিনা পয়সায় পড়ায় ! এক বছর যাবত দুইটা জার্মান ভাষা কোর্স করে যা
বুঝলাম, এই ভাষায় 'guten morgen', 'guten abend' আর 'bitte schön' বলে
বড়জোর হাই হ্যালো করতে পারব, কিন্তু আমার পক্ষে এই
ভাষায় লেখাপড়া করে, মাস্টার্স-পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন
করা সম্ভব হবে না l GRE এর ইংরেজি অংশের সিলেবাসটায় একবার
চোখ বুলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, অন্য যে দেশে যাই যাব,
কিন্তু আমেরিকায় যাব না l জার্মান
ভাষার বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা মনে করে ভাবলাম, জাপানেও
পারবো না, ওখানেও যেয়ে নতুন ভাষা শিখতে হবে l শুরু করলাম IELTS প্রস্তুতি l
ততদিনে
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, DUET এ যোগদান করেছি l চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি,
একে একে অনেক শিক্ষক, জাপান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আর আমেরিকাতে মাস্টার্স-পিএইচডি
করতে ছুটছে l তখন দেশে টেক্সটাইলের ওপর কোথাও কোন
মাস্টার্স ডিগ্রি দেয়া হত না, বিধায় DUET-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের, এনভারমেন্টাল
সায়েন্স ডিসিপ্লিন এর মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে গেলাম l উদ্দেশ্য, টেক্সটাইলের ব্যাচেলর ডিগ্রীর
সিজিপিএ স্কোর ঘাটতিকে পুষিয়ে নিয়ে, বাইরে কোথাও পড়তে
যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা l কিছুদিনের মধ্যে টাঙ্গাইলের
মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় এর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, Higher
Education Quality Enhancement Program (HEQEP)- এর আওতায়
বাংলাদেশে প্রথম মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করল l ছুটে
গেলাম সেখানে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হতে l এর মাঝেই, কিছুদিনের মধ্যেই, হঠাৎ UNIDO নামের একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার স্কলারশিপের জন্য ইংল্যান্ডের Bolton
University তে 'unconditional admission offer letter' চলে আসলো l বাংলাদেশ থেকে আমরা ছয় জন আবেদন
করেছিলাম, বাকি পাঁচ জনেরই 'condition' দিল 'IELTS score' লাগবে, আমাকে কেন 'unconditional offer letter' দিল?!
বিষয় জানতে যেয়ে, নিজের পাকনামি কে এর
জন্য দায়ী হিসেবে আবিষ্কার করলাম ! আমার 'application package' এ, 'medium of instruction certificate' নামে,
একটা সার্টিফিকেট, টেক্সটাইল
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে জুড়ে দিয়েছিলাম, যেখানে লেখা
ছিল আমার আন্ডারগ্রাজুয়েট লেখাপড়া ইংরেজি মাধ্যমে করা হয়েছে l UNIDO কর্তৃপক্ষ কে যেয়ে বললাম, বাকিরা যেহেতু IELTS
করছে, আমিও পরীক্ষা টা দিয়ে দেই,
আমার প্রস্তুতি আগে থেকেই আছে l বাংলাদেশের
কান্ট্রি ম্যানেজার, ভদ্রলোকের নাম John T Smith, আমাকে বলে, "তুমি শুধু শুধু কেন টাকা খরচ
করবে?, ওরাতো তোমাকে এমনিতেই 'unconditional admission'
দিয়েছে", IELTS পরীক্ষা আর দিলাম
না l চার মাস পর যখন সবাইকে স্কলারশিপটা দেয়া হল,
সেখানে আমার নামটা খুঁজে পেলাম না ! পান্থপথে বসুন্ধরা সিটির পাশের
বিল্ডিংয়ে, UNIDO অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, ইংল্যান্ড সংসদে গত কয়েক মাস ধরে, ওদের দেশে
বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে, অনেক বাক-বিতণ্ডা চলেছে l সংসদ ঠিক করেছে, বাইরের দেশ থেকে অনেকেই
ইংল্যান্ডে পড়তে আসার নাম করে চাকুরী করে, তাই IELTS
score বাদে embassy কাউকে ভিসা দিবেনা l
অগত্যা ওরা আমাকে পরের সেমিস্টার এ IELTS দিয়ে যেতে বলল l বাকি পাঁচজন কে পাঠিয়ে দিল
মাস্টার্স করতে l দুই মাসের মধ্যে IELTS পরীক্ষার সিট পেলাম, score ও চলে আসলো,
আবার গেলাম পান্থপথের UNIDO অফিসে,
ওরা এবার বলল, এ বছরের জন্য তো একটা
গ্রুপ চলে গেছে, পরের বছর আরও একটা গ্রুপ করে ওরা পাঠাবে l
মনে মনে খুব রাগ হল, ওদের অফিস থেকে
নেমে পাশে বসুন্ধরা সিটি তে ক্যাপসুল লিফট এ করে নয় তলায় উঠে, অনেকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আর মনে
মনে এলোমেলো সব ভাবতে লাগলাম, কেন আমি 'medium of
instruction certificate' টা দিলাম?! কেন
ছয়জনের গ্রুপ এ সবার আগে 'unconditional admission offer letter' পেয়েও পড়তে যেতে পারলাম না?! উত্তর আসলো
একটাই, তকদির, রিজিক ! এই পুরা
প্রক্রিয়ার মধ্যে, আমার নিজের কোন ভুল পদক্ষেপ, কিংবা দায় বদ্ধতা খুঁজে পেলাম না l নিয়তি কে
মেনে নিলাম l সেদিন এলোমেলোভাবে ঢাকা শহরটা অনেক ঘুরে
অনেক রাত করে গাজীপুরে DUET ক্যাম্পাসে ফিরলাম l এর এক মাসের মধ্যে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় এ প্রথম ব্যাচের মাস্টার্সে
ভর্তি হয়ে গেলাম l
যে GRE পড়বো না বলে ঠিক করেছিলাম,
সেই GRE পড়া শুরু করলাম ! ছয় মাসের
মধ্যে GRE আর TOEFL পরীক্ষা
দিলাম, score ও চলে আসলো আবেদন করার মত l পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয় আবেদন করলাম, কোথাও
থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসার আগেই বিয়ে করে ফেললাম, আবেদনের
পর দীর্ঘ পাঁচ মাসের অপেক্ষার পালা শেষে দুইটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টিচিং
অ্যাসিস্ট্যান্ট সহ অফার লেটার আসলো, দুইটাই পিএইচডি এর
জন্য কন্ডিশন দিল, আমার মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করে যেতে
হবে ! দুই মাসের মধ্যে মাস্টার্স সুপারভাইজার কে সন্তুষ্ট করে ডিফেন্স দিলাম,
DUET এ ছয় বছর তিন মাস চাকুরী করে, মাস্টার্স
ডিগ্রির সব কাজ সম্পন্ন করে, সদ্য বিবাহিত বউকে নিয়ে
লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি তে পিএইচডি করতে চললুম l পরবর্তী
চার বছর ছয় মাসে, নয় টা সেমিস্টার জুড়ে, এমন হাজারো যুদ্ধ শেষে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করতে সক্ষম হই, সে গল্প সুযোগ হলে অন্য কোনদিন বলবো l
এখন
আসি, আমার
ছোট্ট এই জীবনের একটা অংশের যুদ্ধের বিবরণ এত বিশদভাবে কেন বললাম ?!! কমবেশি সবার জীবনেই কঠিন সময় আসে, যুদ্ধ করেই
কঠিন সময় গুলোকে পাড়ি দিতে হয় l জীবন কখনোই নির্ঝঞ্ঝাট,
নির্ভেজাল, শান্তির কোন জায়গা নয় l
এখানে প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা এসে মনকে অস্থির করে তুলবে l
আমার ধারণা, করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট
মহামারী, মোটামুটি সব পেশার, সব
জীবনে, এমন কঠিন সময় আরো বেশি করে নিয়ে এসেছে l যে মানুষটা বেশ ভালো আয় রোজগার করত, তার
হয়তো টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, যে ছেলে-মেয়েগুলো
আন্ডারগ্রাজুয়েট ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে, ওরা হয়তো চাকুরী
নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে, সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায়,
যে ছেলে-মেয়েগুলো বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত
করছিল, যে ছাত্র-ছাত্রী গুলো অনেকটা যুদ্ধ করে, অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে, বিদেশে উচ্চ
শিক্ষা শেষে, চাকুরী পাবার আশায় বুক বেঁধেছিলো, তাদের অনেকের সে আশা হয়তো কিছু সময়ের জন্য একটু এলোমেলো হয়ে গেছে l
এমন লাখ লাখ মানুষের জীবনের সাজানো স্বপ্নগুলো হয়তো ক্ষণিকের
জন্য থমকে গেছে l সেই সকল অস্থির মন গুলোর জন্য আমার এই
ছোট্ট লেখা, আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, 'হাল ছেড়ো না বন্ধু, সম্মুখে সুন্দর আগামী দিন'
l যদি খুব খারাপ লাগে বুক ভরে শ্বাস নাও, দেখবে ভালো লাগবে l
আগুনে
পুড়ে সোনা খাঁটি হয়, আর
হাজারো যুদ্ধ পার করে এসেই জীবন সফলতা পায়, সুখ শান্তির
দেখা পায় l
জীবন
নিয়ে এখন আমার ভাবনা হল, এটা
নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই, এক জীবনে সফলতা আসবে শান্তি
আসবে আনন্দ আসবে খুশির অনেক মুহূর্ত আসবে l একইভাবে,
সেই একি জীবনে, অস্থিরতা আসবে, অসময় এসে হানা দেবে, ঝড় উঠবে, জীবনের কোনকিছুকেই ঠিক মনে হবে না l জীবনে
কিছু কিছু সময় আসে, যখন শুধু কানপাড়া দিয়ে পড়ে থাকতে
হয়, এক একটা দিন বেঁচে পার করতে পারাটাই সফলতা হিসাবে
ধরা হয় l এখন হয়তো অনেকেই সেই সময়টা পার করছে l
করোনার
চাইতে কঠিন যে ভাইরাস তা হল হতাশা অস্থিরতা, সেই রোগের একমাত্র প্রতিষেধক আত্মবিশ্বাস আর আত্মপ্রত্যয় l চড়াই উতরাই জীবনে থাকবেই, ভালো সময়, আর মন্দ সময়, সব নিয়েই জীবন l আমার মনে হয়, জীবন ছোট হলেও বিশালতা অনেক
গভীর, ব্যাপকতা ও অনেক বিস্তৃত, দু
চার বছরের ছোট্ট একটা জীবন অংশ কখনো পুরো জীবনের নির্ধারক হতে পারে না l এখন হয়তো খারাপ সময় যাচ্ছে, ভালো সময়
নিশ্চয়ই আসবে, এই খারাপ সময় গুলোতে আমরা কেমন
প্রতিক্রিয়া করছি, কেমন করে হার টাকে না মেনে নিয়ে আবার
শক্ত করে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি, হয়তো সেসব কিছুই
নির্ধারণ করবে আগামীতে আমরা কে, কোথায়, কেমন ভাবে জীবনটাকে যাপন করব ! আর একটা কথা, জীবনের
হয়তো বেশিরভাগ বিষয় নির্ধারিত হয় নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টার ফল হিসাবে, তারপরও খুব অল্প কিছু বিষয় হয়তো থাকে, যেটাকে
আমরা তকদির বা নিয়তি বলে থাকি l চেষ্টাটা করার ক্ষমতা
আমাদের হাতে আছে, সেটাই আমরা করতে পারি, বাকি নিয়তি যেখানে নিয়ে যায়, সেটাই হবে l
আর জীবনের পরিণতি মেনে নেয়ার মানসিক শক্তিই ঠিক করে দেবে,
আমরা জীবনে সুখী হব, নাকি হতাশাগ্রস্থ
হয়ে তলিয়ে যাব!!
শেষ করব, আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ইংরেজি উক্তি দিয়ে "When you get what you want, that's God's direction, when you don't get what you want, that's God's protection".
লেখকঃ ড. আব্দুল্লাহিল কাফী